নিউইয়র্কে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা সম্পন্ন

রাজিব ভট্টাচার্যের সঙ্গে মধ্যরাত অবধি উপস্থিত ছিলেন ৮৫ বছর বয়সী চারণ কবি বেলাল বেগসহ অসংখ্য প্রবাসী। সকলেই ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ’ গানটি নেচে-গেয়ে পরিবেশন করে দুই দিনের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন গত ২৫ মে, রোববার।বইমেলা কমিটির অন্যতম সংগঠক মিনহাজ আহমেদ সাম্মু বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট কিংবা তারও আগে মধ্য জুলাই থেকে যারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এই সময়েই কিছু শব্দ তৈরি হয়েছে যার একটি হচ্ছে ‘লাল বদর’, যা এসেছে একাত্তরের আল বদরের অনুপ্রেরণা থেকে। এখন আমি একটি নতুন শব্দ যুক্ত করেছি—‘মাল বদর’। আপনারা কেউ এসব হবেন না এবং কাউকে প্রশ্রয় দেবেন না।

মেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক কণ্ঠশিল্পী ও লেখক তাজুল ইমাম বলেন, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা এই প্রথম অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে এমন প্রয়োজন হয়নি, কারণ ‘বাংলা বইমেলা’ বললেই চলতো। কিন্তু এখন বঙ্গবন্ধুর নাম যুক্ত করা প্রয়োজন হয়েছে—কেন, তা আপনারা সবাই জানেন। এখন থেকে এই বইমেলা চালু থাকবে।

মেলা কমিটির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুরন্নবী কানাডায় একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাওয়ায় সমাপনী আয়োজনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে তার নির্দেশনা ও ভাবনা পুরো আয়োজনজুড়ে সক্রিয় ছিল।কমিটির অন্যান্য সংগঠকদের মধ্যে লেখক-কবি ফকির ইলিয়াস, বাচিক শিল্পী মিথুন আহমেদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লুৎফুন্নাহার লতা ও বিপার সংগঠক অ্যানি ফেরদৌস একযোগে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ না ফেরা পর্যন্ত প্রবাসে এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।

বেলাল বেগের উপস্থিতি ছিল পুরো আয়োজনজুড়ে সরব। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে তার বক্তৃতা, গান, কবিতা ও কথকতায় নতুন প্রজন্ম ও প্রবাসীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাবনা মুছে দিতে লাল বদরদের হিংস্র আচরণের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। কমিউনিটির জনপ্রিয় চিকিৎসক ও সমাজকর্মী ডা. সায়েরা হকের পাশে দাঁড়িয়ে মেলা কমিটির অর্থ উপ-কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ফজলুল হক বলেন, এটি কেবল শুরু, শেষ নয়। জাতির পিতার প্রতি যথার্থ সম্মান জানাতে এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে অনাদিকাল পর্যন্ত।

নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সে উডহ্যাভেন বুলেভার্ডে ‘জয়া পার্টি’ হলে এ বইমেলা শুরু হয় ২৪ মে দুপুরে জাতীয় সঙ্গীতের আগে মেলা প্রাঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতিতে নিউইয়র্কে বসসাসরত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের অভিবাদন জ্ঞাপনের মধ্যদিয়ে। এ পর্বে নেতৃত্ব দেন যথারীতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক-বিজ্ঞানী ড. নুরুরন্নবী। মুক্তিযোদ্ধাগণের মধ্যে ছিলেন ড. জিনাত নবী, লাবলু আনসার, আবুল বাশার চুন্নু, গুলজার হোসেন, মোহাম্মদ আলী, হাবিব রহমান আকন্দ, রাশেদ আহমেদ, হেলাল মজিদ, প্রাণ গোপাল কুন্ডু প্রমুখ।

মেলা সম্পর্কিত আলোচনা, কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি, নৃত্য-গীতের পাশাপাশি ছিল মুুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য ছাড়াও বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐহিত্য আলোকে বই-পুস্তকের স্টল। সেগুলোতেও ভীড় পরিলক্ষিত হয়েছে প্রবাস প্রজন্মের। লেখক-কবি-সাহিত্যিকেরাও ছিলেন আড্ডায় মেতে। তারাও পারস্পরিক সম্প্রীতির জয়গানে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সকল অশুভ তৎপরতাকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র রুখে দিতে বদ্ধ পরিকর বলে মন্তব্য করেছেন।

কবি ও আবৃত্তি শিল্পী জি এইচ আরজুর সঞ্চালনায় প্রবাসের ক’জনের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থের মোড়ক উম্মোচনী পর্বেও সমস্বরে উচ্চারিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বাতিঘর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ধ্বংসের জন্যে দায়ীদের নির্মূল না করা পর্যন্ত সরব থাকার অঙ্গিকার। কবি-লেখক-সাহিত্যিকগণের মধ্যে এ সময় মঞ্চে ছিলেন ড. নুরুন্নবী, ফারহানা তুলি, মঞ্জুর কাদের, আবু সাঈদ রতন, খালেদ শরফুদ্দিন, শিমু আতার অ্যানি, নাজনীন সিমন, মিশুক সেলিম, লুৎফুন্নাহার লতা, ডা. অনুপমা বড়ুয়া, বদিউজ্জামান নাসিম, রত্না বাড়ৈ, বনানী সিনহা, ড. দেলোয়ার আরিফ, সুব্রত বণিক।

গোপন সাহা, সাবিনা শারমিন এবং তাহরিনা পারভিন প্রীতির সম্মিলিত সঞ্চালনায় সমাপনী দিবসে সাংবাদিক-লেখক-নির্মাতা শামিম আল আমিন নির্মিত প্রামান্যচিত্র ‘জাতির যাদুঘর’ প্রদর্শনের সময় পুরো মিলনায়তনে ভিন্ন এক আবহ তৈরী হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন সকলে। ছি: ছি: ধ্বনিতে ধিক্কার জানান ইউনূস ও তার চেলা চামুন্ডাদেরকে। সে সময় মঞ্চের পাশে সাদা পর্দায় ভাসতে দেখা যায় ‘টেসলা’ রিক্সার ছবি। রওশনআরা নিপা নির্মিত বীরাঙ্গনা নারীর কাহিনী চিত্র এবং নাসরীন আক্তার নির্মিত ‘স্বাধীনতায় ডাক টিকিট’র অবদান শির্ষক ডক্যুমেন্টারি প্রবাসী বাঙালিদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে নতুন যোগসূত্র স্থাপনে অনন্য এক অবলম্বন বলে মনে করা হচ্ছে।

দায়িত্বশীল সাহিত্য ও প্রজন্মের সম্পৃক্ততা শীর্ষক এক মনোজ্ঞ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় আসলাম আহমেদ খানের সঞ্চালনায়। বিষয়বস্তুর আলোকে গবেষণামূলক লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি। আলোচনায় আরো অংশ নেন লেখক-সাংবাদিক বদিউজ্জামান খসরু এবং রাজনীতিক রাফায়েত চৌধুরী।

এ মেলায় জারিন মাইশা, মুন হাই, ফাবিহা নিসা, জাহিন হোসেন, তানিয়া সৈয়দ দিয়া, আনিসা হোসেনের পরিবেশনা সকলকে আপ্লুত করেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনে গান আর কবিতার জয়গানে অভিভ’ত করেছেন শিল্পীরা। জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী ও কন্ঠশিল্পীগণের মধ্যে আরো ছিলেন হাসানাল আব্দুল্লাহ, দিনাত জাহান মুন্নি, তৃষ্ণা মাহমুদ, তাহমিনা শহীদ, আবির আলমগীর, কান্তা আলমগীর, সেলিমা আশরাফ, নিলোফার জাহান, পারভিন সুলতানা, শুক্লা রায়, রুদ্রনীল দাশ রূপাই, আমিনা ইসলাম, কামেলা সোফি আলম, পিঙ্কি চৌধুরী, পাপড়ি বড়ুয়া, সেজান মাহমুদ, আনিসা হোসেন, এলমা রুদ্রমিলা, দিনার মনি, লিমন চৌধুরী, তন্ময় মজুমদার, মুমু আনসারী, সুতপা মন্ডল, শিমু আকতার অ্যানি, ছন্দা বিন্তে সুলতানা, বিদিশা দেওয়ানজি, লিপি রোজারিয়ো, ড. বিলকিস রহমান দোলা, শাহরিয়ার সালাম প্রমুখ। যন্ত্রে ছিলেন পিনু সেনদাস, মাসুদ, জিতু প্রমুখ।

বইমেলার প্রবেশ পথ থেকে পুরো মিলনায়তন জুড়েই বাঙালি সংস্কৃতির আবহ তৈরী হয়েছিল শিল্পী তাজুল ইমামের ছোঁয়ায়। আগতরা অভিভ’ত এবং আপ্লুত বঙ্গবন্ধু ও বাঙালিত্বতে হৃদয়ে ধারণ ও লালনে অক্লান্ত এ প্রয়াসে। দর্শক-শ্রোতার মধ্যে লেখক-সাহিত্যিক-কবি ছাড়াও ছিলেন রাজনীতিক-সমাজকর্মী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও। সপরিবারেও অনেকে এসেছিলেন।বিজ্ঞপ্তি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *