ট্রাম্পের সৌদি সফর: ‘ইতিহাসের বৃহত্তম অস্ত্র চুক্তি’র সঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা

প্রথম মেয়াদের মতো এবারও প্রথম দেশ হিসেবে সৌদি আরব সফর করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সৌদি আরবের মোট ৬০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে বলে দাবি করেছে হোয়াইট হাউস, যার মধ্যে আছে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রি চুক্তি’। সিরিয়ার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন এই সফরেই।

তবে সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, চুক্তিগুলোর বিস্তারিত তথ্য এখনো স্পষ্ট না। এবং অনেক চুক্তিই আগে থেকে প্রক্রিয়াধীন। নিউইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা ও রয়টার্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই সফরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও চুক্তিগুলো তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।

সফরের সবচেয়ে বড় চুক্তিটি হয়েছে অস্ত্র বিক্রি সংক্রান্ত। এক ডজনের বেশি মার্কিন অস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সৌদি আরবকে প্রায় ১৪২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ও পরিষেবা দেওয়ার চুক্তি হয়েছে। চুক্তির আওতায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তাও দেবে যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তিকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রি চুক্তি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে হোয়াইট হাউস।

যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ডাটা সেন্টার ও জ্বালানি অবকাঠামোতে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সৌদি কোম্পানি ডাটাভোল্ট। অপরদিকে গুগল, ওরাকল, সেলসফোর্স, উবারের মতো মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো দুই দেশ মিলিয়ে প্রযুক্তি খাতে ৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও এই অর্থ কীভাবে বণ্টন করা হবে, তার বিস্তারিত জানায়নি হোয়াইট হাউস।

এদিকে এনভিডিয়া সৌদি এআই ফার্ম হুমাইনকে অত্যাধুনিক এআই চিপ সরবরাহের ব্যাপারে চুক্তি করেছে। ১৮ হাজার ব্ল্যাকওয়েল জিপিইউ চিপ সরবরাহের মধ্য দিয়ে শুরু হবে চুক্তির বাস্তবায়ন। আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান, এএমডি ১০ বিলিয়ন ডলারের এআই হার্ডওয়্যার দেবে হুমাইনকে।

হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বাদশাহ সালমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বাদশাহ সালমান পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র কিদ্দিয়া সিটিসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়টিও নথিভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি পাবে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ট্রাম্পের সফরের আগেই এসব প্রকল্পের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো।

নাসার আর্টেমিস টুর পরীক্ষামূলক ফ্লাইটে একটি সৌদি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চুক্তিও হয়েছে। বিপন্ন আরব চিতাবাঘ সংরক্ষণ করে ওয়াশিংটনে প্রদর্শনী তৈরির লক্ষ্যে একটি চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল জু ও আল-উলা রয়্যাল কমিশন।

এছাড়া মার্কিন বিচার বিভাগের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে সৌদি প্রশাসন। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সংক্রান্ত আরেকটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। এর বাইরে মহাকাশ ও সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত সহযোগিতা বৃদ্ধিতে চুক্তি করেছে দুই দেশ।নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, হোয়াইট হাউসের দেওয়া বিস্তারিত হিসাব যোগ করলেও মোট চুক্তির অঙ্ক ৬০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছিও থাকে না। হোয়াইট হাউস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আরও অনেক চুক্তি হয়েছে যা পরে ঘোষণা করা হবে।

এদিকে ট্রাম্পের সফরকালে সৌদির বিনিয়োগ ফোরামে মোট ১৪৫টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন প্রশাসন, যার মোট মূল্য ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বলে দাবি করা হয়েছে।সিরিয়ার ওপর থেকে থেকে সব মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়াটা ছিল সফরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘোষণা। সাবেক আল-কায়দা যোদ্ধা আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার নতুন প্রশাসন সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি দামেস্কের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণাও দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।আল-শারার সঙ্গে আলাদা বৈঠকও করেছেন ট্রাম্প। যেখানে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে ‘ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের দেশছাড়া করার’, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আব্রাহাম অ্যাকর্ডে সই করার এবং ইসলামিক স্টেটসের (আইএস) ঘাঁটিগুলোর দখল নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প বলেছেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়াটা একটি ‘স্বপ্ন’, তবে এ ব্যাপারে চাপ দেবেন না তিনি। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানায়, এর আগে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল সৌদি আরবকে। কিন্তু ট্রাম্পের এবারের সফরে পরিষ্কার হয়েছে, এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ যে সম্ভব না, তা বুঝতে পারছে বর্তমান প্রশাসন।

গাজায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলে এসেছেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না তার দেশ।সফরে এক বক্তৃতায় ইরানের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ইরান। সেজন্য ইরানকে কখনো পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।ইসরায়েলের ঘোর দ্বিমত সত্ত্বেও বর্তমানে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। ইয়েমেনের হুতিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিও সেই আলোচনার কারণেই হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন ট্রাম্প। বলেছেন, ‘কেউ চিরকাল শত্রু থাকবে, এই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী না আমি।’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *